যাকাতের হিসাব | Zakat in Bangla | Jakat Dewar Niyom
রসুলুল্লাহ (সঃ) এর সময়ে সাড়ে ৭ ভরি/তোলা স্বর্ণের মূল্য এবং সাড়ে ৫২ ভরি/তোলা রৌপের মূল্য প্রায় সমান ছিল। কিন্তু বর্তমান সময়ে রৌপের মূল্য কমতে কমতে এমন পর্যায়ে এসেছে যে সাড়ে ৭ ভরি সোনার মূল্য এবং সাড়ে ৫২ ভরি রৌপের মূল্যে বিশাল পার্থক্য দেখা দিয়েছে। রৌপ্যকে আদর্শ ধরে কেউ যাকাত আদায় করতে চাইলে তিনি তা করতে পারবেন। অথবা স্বর্ণকে আদর্শ ধরে যাকাত আদায়ের জন্য অপেক্ষা করতে পারেন।
প্রতি চন্দ্র বছরে একই তারিখে যাকাতের হিসাব করতে হবে। যেমন ১ম রমজান সন্ধ্যা ৭টা। এই সময়ের এক সেকেন্ড আগে যে সম্পদ আসবে তা যাকাত হিসাবের অন্তর্ভূক্ত হবে। এই সময়ের ১ সেকেন্ড পর যে সম্পদ আসবে তা পরবর্তী বছরের হিসাবে চলে যাবে। চন্দ্রবর্ষ বা ৩৫৪ বা ৩৫৫ দিনে হয়ে থাকে। যেহেতু সৌরবর্ষ ৩৬৫ দিনে বা ৩৬৬ দিনে হয়, তাই সৌরবর্ষ অপেক্ষা চন্দ্রবর্ষ ১১ বা ১২ দিন কম। সৌরবর্ষ হিসাবে যাকাত আদায় করতে চাইলে শতকরা ২.৫% এর পরিবর্তে (২.৫% ভাগ ৩৫৪ * ৩৬৫) ২.৫৭৮% বা ২.৫৮% দিতে হবে। অথবা মূল যাকাতের সাথে অতিরিক্ত ১১ দিনের হিসাব যোগ করতে হবে। যথা ২.৫% ভাগ ৩৫৪ * ১১।
নিসাব একবার ছুটে গেলে পুনরায় নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে নতুন করে সেদিন থেকে নিসাবের হিসাব ধরতে হবে। বছরের মাঝখানে নিসাবের কম-বেশী ধর্তব্য নয়। যাকাতের হিসাবের তারিখে নিসাব থাকলেই হবে।
মৌলিক যাকাতযোগ্য সম্পদ
মৌলিক যাকাতযোগ্য সম্পদ চার প্রকার। যথাঃ
২। ব্যবসায়িক সম্পদ
৩। স্বর্ণ/রৌপ্য বা তার পরিবর্তে ব্যবহৃত যে কোন কারেন্সি বা মুদ্রা টাকা, ডলার, পাউন্ড, রিয়াল বিটকয়েন ইত্যাদি।
৪। পশু-প্রাণী বা চতুস্পদ জন্তু
বাসা-বাড়ির যাকাতযোগ্য সম্পদ
২ যে কোন জমানো ও নগদ অর্থ
৩। ফেরৎ পাবার সম্ভাবনা আছে এমন কর্য বা পাওনা টাকা
বাসা-বাড়ির সম্পদ যা যাকাতযোগ্য নয়
- ব্যবহৃত যানবাহন
- ব্যবহৃত আসবাবপত্র (টিভি, ফ্রিজ, এসি)
- বসবাসের জন্য বাড়ী
ব্যবসায়িক সম্পদ (যাকাতযোগ্য)
২। বিক্রিযোগ্য তৈরীকৃত যে কোন পণ্য
৩। তৈরীর প্রক্রিয়াধীন পণ্য
পৈত্রিকসূত্রে প্রাপ্ত জমি বা কোন উদ্দেশ্য ছাড়াই জমি ক্রয় করা হয়ে থাকলে তার যাকাত দিতে হবে না। তবে জমি বা প্লট, বাড়ি বা ফ্লাট, গোডাউন ইত্যাদি ভাড়ায় দিয়ে রাখলে এই মূল সম্পদের কোন যাকাত দিতে হবে না তবে ভাড়া থেকে প্রাপ্ত নগদ অর্থ যাকাতের অন্তর্ভূক্ত হবে। জমি বা প্লট, বাড়ি বা ফ্লাট ইত্যাদি যদি ব্যবসা বা বিক্রয় করার উদ্দেশ্যে ক্রয় করা হয়ে থাকে তবে এই সম্পদের যাকাত দিতে হবে। তবে যে পরিমাণ অর্থ দিয়ে ক্রয় করা হয়েছে তার উপর যাকাতের হিসাব করা যাবে না। বরং যেদিন যাকাতের হিসাব করা হবে সেই দিন ঐ জমি বা প্লট, বাড়ি বা ফ্লাটের যে বাজার মূল্য হবে তার উপর যাকাতের হিসাব করতে হবে।
ভাড়ায় দেয়া গাড়িঃ ভাড়ায় দেয়া গাড়ির কোন যাকাত দিতে হবে না তবে ভাড়া হিসাবে প্রাপ্ত অর্থ যাকাতের হিসাবের অন্তর্ভূক্ত হবে।
গবাদি পশুঃ গরু, মহিষ, ভেঁড়া, ছাগল ইত্যাদি লালন-পালন করলে সেটার যাকাতের নির্দিষ্ট সংখ্যক হিসাব রয়েছে। যদি স্বতন্ত্রভাবে ছাগল ৪০টি, গরু ৩০টি, উট ৫টি বা এর বেশী থাকে তাহলে সুনির্দিষ্টহারে গবাদি পশুর যাকাত ফরজ হয়। গবাদি পশু এই সংখ্যায় না পৌঁছালে ব্যবসায়িক সম্পদ হিসাবে গণ্য হবে। গরু-ছাগল ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যবসা করলে যেদিন যাকাত বের করবেন সেদিনের বিক্রয়যোগ্য গরু-ছাগলের বাজারমূল্য অনুযায়ী যাকাত বের করতে হবে। এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোন সংখ্যা ধর্তব্য হবে না।
মাছের ক্ষেত্রেঃ পুকুরে বা ঘেরে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে মাছের চাষ করলে ঐ পুকুর বা ঘের-এর কোন যাকাত দিতে হবে না তবে চাষকৃত মাছের সম্ভাব্য বাজার মূল্য নির্ধারণ করে যাকাত দিতে হবে।
যাকাত দাতা হওয়ার শর্তাবলীঃ
- যিনি যাকাত দিবেন তারমধ্যে নিচে বর্ণিত বৈশিষ্ট্যগুলো থাকতে হবে।
- প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া
- যাকাত দেয়ার জন্য নিয়ত করা
- বিবেক সম্পন্ন হওয়া
যাকাতের হিসাব থেকে যা বাদ যাবে
কর্য বা ঋণঃ পারিবারিক প্রয়োজনে বা অন্য কোন জরুরী প্রয়োজনে আপনি ঋণ নিয়ে থাকলে যাকাতের হিসাবের দিন এই ঋণ বাদ দিয়ে যাকাতের হিসাব করতে হবে। যদি এই ঋণ এককালীন পরিশোধযোগ্য হয়ে থাকে তবে যাকাতের হিসাবের দিন এই ঋণ বাদ দিয়ে যাকাতের হিসাব করতে হবে। ধরুন আপনি ১০০,০০০ (এক লাখ) টাকা ঋণ নিয়েছেন। এখন এই ঋণ যদি এককালীন পরিশোধযোগ্য হয়ে থাকে তবে যাকাতের হিসাবের দিন এই এক লাখ টাকা বাদ দিয়ে যাকাতের হিসাব করতে হবে।
খুব সহজে যাকাতের নমুনা হিসাবঃ
অর্থ্যাৎ আপনার যাকাত আদায়ের অর্থের পরিমাণ হলো ৩৫,০০০/= (পঁয়ত্রিশ হাজার) টাকা।
যাকাত প্রাপকঃ ফকির, মিসকিন, দরিদ্র ও অভাবী, নিঃস্ব, ঋণগ্রস্থ ব্যক্তি, পথযাত্রী, অভাবী পথিক, নওমুসলিম, এবং মুসাফির ব্যক্তিকে যাকাত দেয়া যাবে।
ফকিরঃ শারীরিক ও মানষিকভাবে কর্মক্ষম হওয়া সত্বেও প্রতিকূল অবস্থার কারণে বেকার ও উপার্জনহীন হয়ে পড়েছে। যে সব অভাবগ্রস্থ মেহনতি লোক কোন জালিমের জুলুম হতে আত্বরক্ষার জন্য জন্মভূমি ছেড়ে চলে আসতে বাধ্য হয়েছেন তাদেরকের ফকির বলা যেতে পারে।
মিসকিনঃ দৈহিক অক্ষমতা যাকে নিস্কর্মা ও উপার্জনহীন করে দিয়েছে তাকে মিসকিন বলে। বার্ধক্য, রোগ, পঙ্গুত্বের কারণে উপার্জনের সুযোগ হতে বঞ্চিত হয়েছে অথবা সে উপার্জন করতে পারলেও সে তার নিজের প্রকৃত প্রয়োজন মেটাতে পারে না। অন্ধ, অনাহারী, আশ্রয়হীন শিশু এদেরকে মিসকিন বলা হয়।
নওমুসলিমঃ নওমুসলিমকে স্বনির্ভর করার জন্য যাকাতের অর্থ ব্যয় করা যাবে।
ক্ষতিগ্রস্থ ও ঋণমুক্তিঃ যারা নিজেদের অতি প্রয়োজনীয় চাহিদাগুলো পূরণ করতে গিয়ে ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়েছেন এবং সে এই ঋণ পরিশোধে অক্ষম হয়ে পড়েছে এমন ব্যক্তিকে যাকাতের অর্থ হতে সাহায্য করা যাবে। আবার যাদের ঘর-বাড়ি আগুনে পুড়ে গেছে অথবা বন্যার কারণে আসবাব ভেসে গেছে তাদের পরিবার-পরিজনের ভরণ-পোষণের জন্য যাকাতের অর্থ দেয়া যেতে পারে।
মুসাফিরঃ সৎ উদ্দেশ্যে দেশ ভ্রমণে বের হয়ে যারা পথিমধ্যে নিঃসম্বল, অসহায় হয়ে পড়েছে তাদেরকেও যাকাতের অর্থ দেয়া যাবে। এ ছাড়াও এমন কোন প্রতিষ্ঠান যারা যাকাত আদায় ও বিতরণ পরিচালনার কাজ করে থাকে তাদেরকে যাকাত দেয়া যাবে।
ব্যক্তি এবং সমাজের উপর যাকাতের প্রভাবঃ
যাকাত ব্যক্তি এবং সামগ্রিকভাবে সমাজ উভয়ের জন্যই অপরিসীম তাৎপর্য বহন করে থাকে। যাকাত ব্যক্তির সম্পদকে শুদ্ধ করে এবং তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসকে শক্তিশালী করে। যাকাত প্রদানের মাধ্যমে ব্যক্তি সমাজের কল্যাণ ও উন্নয়নে অবদান রাখে। যাকাত সম্পদের বৈষম্য হ্রাস করে আর্থ-সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য অনুঘটক হিসেবে কাজ করে।
উপসংহারঃ
ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে যাকাত তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। প্রত্যেক ধনবান মুসলমানের উপর যাকাত আদায় করা ফরজ। যাকাত প্রদান না করা ইসলামী নীতির লঙ্ঘন। যাকাত সম্পদের রক্ষা কবচ। যাকাত আদায় না করলে সম্পদের বরকত রক্ষা হয় না। যাকাত সম্পদকে বৃদ্ধি করে। যাকাত সম্পদকে পবিত্র করে। যাকাত আদায় এতটাই জরুরী যে যাকাত নেয়ার কেউ না থাকলে যাকাতের অর্থ ডাষ্টবিনে ফেলে দিয়ে আসতে হবে। যাকাতের অর্থ বাড়িতে রাখা গোখরা সাপ রাখার চাইতেও বিষাক্ত ও ভয়ংকর। তাই আসুন নিজ নিজ সম্পদের সঠিক হিসাব করি এবং পরিপূর্ণ যাকাত আদায় করি। আল্লাহ তা’আলা আমাদের সবাইকে যাকাত আদায়ের তৌফিক দান করুন। এই রচনাটি ইসলামে যাকাতের তাৎপর্যের মৃদু অনুস্বারক হিসাবে কাজ করুক। আমিন।
0 Comments: